খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ছাড়াও মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে চিত্তবিনোদন অন্যতম। বিনোদন সংস্কৃতির এক ক্ষুদ্র অংশ।
সংস্কৃতি ব্যাপক বিষয় যার মধ্য দিয়ে একটি জাতি বা গোষ্ঠীর কৃষ্টি, বিশ্বাস, দর্শন, ইতিহাস ইত্যাদি প্রকাশ পায়। খেলা, সংগীত, নৃত্য, চলচ্চিত্র, মঞ্চ নাটক, বিভিন্ন প্রদর্শন কলা ইত্যাদি বিনোদনের বিভিন্ন মাধ্যম সামগ্রিক সংস্কৃতির এক একটি অংশমাত্র। বিনোদনের বিভিন্ন মাধ্যম মানুষের জীবিকাও বটে। জীবিকার তাগিদে তাই বহুরূপ বিনোদনের আবির্ভাব হয়েছে। সব বিনোদনই যে হৃদয়কে আকৃষ্ট করে তা নয়। হৃদয়ে দাগ কাটা বিনোদনই সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করে।
প্রযুক্তির কল্যাণে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে যাওয়া বিশ্বের সঙ্গে বদলে গেছে বিনোদন দুনিয়াও। বাংলাদেশের বিনোদন অঙ্গনও সেই পরিবর্তনের হাওয়ায় পাল তুলেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে একটা স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ যে কারও হাতের মুঠোয় এনে দিচ্ছে সারা বিশ্বের বিনোদন জগৎ। সিনেমা হল, টিভি, ডিভিডি ছাড়িয়ে বিনোদন স্থান করে নিয়েছে ডিজিটাল স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে।
নানারকম ঝক্কি-যানজট ঠেলে হলে যাওয়া, টিকিট কাটা বা নির্দিষ্ট শোর সময় মেনে সিনেমা দেখার বাধ্যবাধকতা যাদের হলে সিনেমা দেখা থেকে বিরত রাখছে, তাদের এসব ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো। ডিজিটালভাবে মুক্তি পাওয়ামাত্রই একযোগে সেসব দেখার সুযোগ পাচ্ছেন সারা বিশ্বের দর্শক। বিশ্বের আর সব দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কদর বেড়েছে ডিজিটাল স্ট্রিমিং সাইটের। বিনোদন নিয়ে কেবল দর্শকের রুচির পরিবর্তনই নয়, নির্মাণ আর বিনোদনের সঙ্গে যুক্ত সবার ক্ষেত্রেই আমূল পরিবর্তন এনেছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। পরিবর্তিত এই বিনোদন জগতে মানুষ আগের চেয়ে স্বাধীন ও সহজভাবে বিনোদন পাচ্ছে।
রুচির দুর্ভিক্ষ : আধুনিক ডিজিটাল এই যুগের সুবিধা কতটাই বা কাজে লাগাতে পারছি আমরা! মানুষের মধ্যে সচেতনতাবোধ আর রুচিস্নিগ্ধতা না থাকায় সমাজের কিছু গুরুতর সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। বিনোদন প্রদানের পাশাপাশি মানুষের মনে যুক্তি, সুরুচি, আর চিন্তার গভীরতা সৃষ্টির প্রতিও নজর দেওয়া জরুরি। এই ডিজিটাল যুগে সেসব সমস্যা দৃষ্টিগোচর করা অনেকটাই সহজ। হালকা বিনোদনধর্মী উপাদানের বহুল প্রচার মানুষকে ক্ষণিক আকর্ষণ ও কিছু মানুষের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করছে, কিন্তু এমন উপাদানের প্রতি আসক্তি যে বহু মানুষকে চিন্তাশীলতা, সুরুচি আর যুক্তিবোধ অর্জনে অক্ষম করে তুলছে তা আমাদের বিবেচনা করা প্রয়োজন। ভালো বই পড়া, ভালো চলচ্চিত্র দেখার অভ্যাস এখন কম। সমাজে চিন্তাশীলতা চর্চার যে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে তা কি আমাদের যুক্তি আর রুচির অভাব সৃষ্টি করছে না? মানুষের মনোভঙ্গি আর চেতনা তৈরিতে বড় প্রভাব রাখে সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ। গণমাধ্যমের উপাদান দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হওয়ার এই সময়ে যে ধরনের নাটক আমাদের দেশে বেশি তৈরি হচ্ছে যা প্রায়ই থাকে হালকা বিনোদন যা বিনষ্ট করে সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক পরিবেশ। নান্দনিক উপস্থাপন, অভিনব নির্মাণশৈলী, উঁচুমানের মর্মস্পর্শী কাহিনির বদলে এখন চলছে সেলিব্রেটি হওয়ার দৌড় প্রতিযোগিতা। যে যেমনভাবে পারছে ভাইরাল হতে চাচ্ছে। কন্টেন্ট যাই হোক, যার ভিউ যত বেশি সে তত বড় সেলিব্রেটি। কেবল ভিউ বাণিজ্যের তোড়জোড়। কিন্তু বিনোদনে সৃজনে স্মার্ট বাংলাদেশের বিনোদন জগতের নাগরিকদের হতে হবে সৃজনশীল, সুরুচিপূর্ণ, সুশিক্ষিত। তবেই হয়তো আমরা পাব একটি স্মার্ট বিনোদন অঙ্গন।